পান্না-রহস্য (প্রথম পর্ব)
কাহিনী রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন । তিন গোয়েন্দায় রুপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব
এক
কিশোর চিঠিটা হাঁটুর ওপর রেখে জোরে পড়ে শোনাল:
‘প্রিয় কিশোর,
তুই আসছিস বলে আমার খুব ভালো লাগছে। তোর আর তোর বন্ধুদের নিউইয়র্ক ভালো লাগবে। শুক্রবার চারটের সময় এয়ারপোর্টে থাকব আমি।
ভালোবাসা নিস,
হিরু চাচা।’
হিরু চাচা কিশোরের বাবার চাচাতো ভাই। বিজ্ঞানী মানুষ। বিয়ে-থা করেনি। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। কোনো কাজে বেশি দিন থিতু হয় না।
হিরু চাচা ওদের নিতে এসেছে। কোটের কলারে লাল গেলাপ। চোখে সানগ্লাস।
‘এসেছিস?’ চেঁচিয়ে উঠল হিরু চাচা। ‘খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই!’
‘চাচি আমাদের জন্য স্যান্ডউইচ করে দিয়েছিল,’ জানাল কিশোর।
‘গুড। এখন চল, ক্যাব ভাড়া করি!’
এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই কানে তালা লাগার জোগাড়। হর্ন বাজছে, কড়া ব্রেকের শব্দ, উচ্চ স্বরে গান আর খাবারের দোকানদারদের ডাকাডাকি।
হিরু চাচা হাত নেড়ে শিস বাজাল। হলদে একটি ক্যাব শাঁ করে এসে হিরু চাচার পায়ের কয়েক ইঞ্চি দূরে ব্রেক কষে দাঁড়াল।
’আমি ওদের সাথে গিয়েছিলাম । ওরা চলে গেলে লক করে দিয়েছি, ‘ বলে এক গোছা চাবি তুলে দিলেন হিরু চাচার হাতে ।
পেছনের দরজা টেনে খুলল হিরু চাচা।
‘ঢুকে পড়!’ চেঁচাল।
বসে দরজা সবে লাগিয়েছে, ঝাঁকি মেরে রওনা হলো ক্যাব।
‘কোথায়?’ কাঁধের ওপর দিয়ে প্রশ্ন করল ড্রাইভার মহিলা।
‘নাম্বার থ্রি ফর্টি, ওয়েস্ট ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড টেন্থ স্ট্রিট,’ হিরু চাচা বলল।
এবার ছেলেদের দিকে ঘুরে চাইল।
‘আগে জাদুঘরে যাব। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে একটা শিপমেন্ট আসার কথা।’
চওড়া এক অ্যাভিনিউয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকল গাড়ি। অগুনতি গাড়ি, ট্যাক্সি, বাস, বাইক আর মানুষ পরস্পর পরস্পরকে এড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। ট্যাক্সির বন্ধ জানালার ভেতর থেকেও বিশাল শহরটার হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে পারছে কিশোর।
বিশ মিনিট বাদে, ট্যাক্সি সাদা মার্বেলের তৈরি এক বিল্ডিংয়ের সামনে থেমে দাঁড়াল।
‘পৌঁছে গেছি,’ জানাল ড্রাইভার।
হিরু চাচা তার হাতে বিল গুঁজে দিল।
‘কিপ দ্য চেঞ্জ, প্লিজ,’ বলল।
‘ধন্যবাদ, মিস্টার’ বলে রিয়ারভিউ মিররে হাসল মহিলা।
ট্যাক্সি থেকে নেমে এল হিরু চাচা আর তিন গোয়েন্দা।
‘আমি এখানে কাজ করি,’ বলল চাচা। সবুজ এক দরজার পাশে তামার ছোট এক সাইন ইঙ্গিত করল। সাইন বলছে: দ্য পোর্টার মিউজিয়াম।
চারদিক শান্ত। বিল্ডিংয়ের সামনে গাছপালার সারি। কয়েকটা ছেলেমেয়ে সাইডওয়াকে চক দিয়ে ছবি আঁকছে। রাস্তার ওপাশের একটি জানালা দিয়ে পিয়ানোর শব্দ আসছে।
হঠাৎ একটি কণ্ঠ শোনা গেল, ‘হিরন! হ্যালো!’
জাদুঘরের পাশে ছোট একটা রেস্তোরাঁ। তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা।
তাঁদের পেছনে চওড়া একটি জানালায় সাইন। তাতে লেখা: লে পেটি বিস্ট্রো।
‘আয়, আমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই’ বলে হিরু চাচা তাঁদের দিকে এগোল।
ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
‘এ হচ্ছে জাঁ পিয়েরে আর ইনি ওর স্ত্রী মিশেল,’ বলল হিরু চাচা।
সাইনটা দেখাল সে।
‘এরা শহরের সেরা ফরাসি রেস্টুরেন্টটার মালিক!’
‘হ্যালো!’ মহিলা আর পুরুষ একই সঙ্গে বললেন। মুখে মৃদু হাসি।
‘নাইস টু মিট ইউ,’ ছেলেরাও কোরাসে বলল।
মিশেল ঘুরে দাঁড়ালেন হিরু চাচার দিকে।
‘এসেছে! বড়, ভারী একটা বাক্স। চারজন মিলে ওপরে তোমার অফিসে নিয়ে গেছে।’
পকেটে হাত ঢোকালেন জাঁ পিয়েরে।
‘আমি ওদের সাথে গিয়েছিলাম। ওরা চলে গেলে লক করে দিয়েছি,’ বলে এক গোছা চাবি তুলে দিলেন হিরু চাচার হাতে।
‘বাক্সে কী আছে?’ কিশোরের প্রশ্ন।
চোখ টিপল হিরু চাচা।
‘তেমন কিছু না, স্রেফ মহামূল্যবান সোনা!’
দুই
সবুজ দরজা দিয়ে হিরু চাচাকে অনুসরণ করল ছেলেরা। কার্পেটে মোড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটি দরজার সামনে দাঁড়াল তারা। হিরু চাচা তালা খুলতেই ওরা প্রশস্ত, স্বল্পালোকিত একটি কামরায় প্রবেশ করল।
মেঝেতে কাঠের একটি বাক্স। প্রায় কিশোরের সমান লম্বা।
ঘরের চারপাশে নজর বুলিয়ে নিল কিশোর। প্রাচ্যের একটি গালিচার ওপরে একটা ডেস্ক আর কিছু চেয়ার। ডেস্কের কাছে বুদ্বুদ তুলছে এক মাছের ট্যাংক। দেয়ালে ঠেস দেওয়া একটি বুককেস।
কিশোর আরেকটা দরজা দিয়ে উঁকি মেরে একটি ডেস্কের ওপর কম্পিউটার, একটি ফাইল ক্যাবিনেট আর কিছু বুকশেলফ দেখতে পেল।
‘আমার সহকারী ওখানে কাজ করে,’ বলল হিরু চাচা। ‘বিকেলে ছুটি নিয়েছে। আজকে ওর মেয়ের জন্মদিন, তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গেছে।’
‘এখানে চিড়িয়াখানা আছে?’ মুসার প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, ম্যানহাটানের মাঝখানে সেন্ট্রাল পার্ক চিড়িয়াখানা,’ বলল হিরু চাচা। ‘খুব ছোট, তবে ব্রংক্স চিড়িয়াখানাটা বিশাল!’
দেয়ালের তিনটি সুইচ টিপে দিল হিরু চাচা। সিলিং ফ্যান চালু হয়ে গেল। গুপ্ত স্পিকার থেকে বাজনা শোনা গেল। মাথার ওপর থেকে আলো এসে পড়ল ওদের ওপর।
‘অফিসটা দারুণ,’ বলল কিশোর।
‘ধন্যবাদ,’ বলল হিরু চাচা।
মাছের ট্যাংকটার দিকে আঙুল নির্দেশ করল।
‘মাছেদের কে খাওয়াতে চাও?’
‘আমি!’ বলে উঠল রবিন।
হিরু চাচা ওকে মাছের খাবারের একটা প্যাকেট দিল। বলে দিল কতখানি খাবার ছিটাতে হবে।
‘এটা দেখো!’ বলে ডেস্ক থেকে চকচকে একটি রুপোলি ছোরা তুলে নিল মুসা। ফলা বাঁকানো, হাতলটা বাজপাখির মতো।
‘সাবধান, ভীষণ ধার। আমি ওটাকে চিঠি খোলার জন্য ইউজ করি,’ বলল হিরু চাচা।
‘এটা কি সত্যিকারের রুপা?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।
‘জিনিসটা স্পেনে তৈরি, প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো।’
‘এতে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে!’ বলল মুসা।
হেসে উঠল হিরু চাচা।
‘এর কারণ আমার সহকারী রোজ সকালে ওটাকে পালিশ করে।’
টি-শার্টে ছোরাটা মুছে ডেস্কে রেখে দিল মুসা।
‘এখন দেখা যাক এখানে কী আছে,’ বলল হিরু চাচা। স্যুট–জ্যাকেট চেয়ারে ঝুলিয়ে ক্লজেট থেকে একটা টুলবক্স বের করল। ছোট একটি ক্রোবার বেছে নিল। বাক্সের ঢাকনার নিচে চোখা প্রান্ত ঢুকিয়ে ওপরটা তুলে ফেলল।
ভেতরে গাদা গাদা সাদা প্যাকিং পিনাট। পিনাটের মধ্যে হাত ভরে বাদামি কাগজে মোড়া ছোট একটি প্যাকেজ টেনে বের করল হিরু চাচা।
কাগজটা ছিঁড়ে প্লাস্টিক বাবল র৵াপের একটি স্তর বের করল। সাবধানী হাতে প্লাস্টিক খসাতেই বেরিয়ে পড়ল সোনার একটি কাপ।
‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা।
ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসল হিরু চাচা।
‘সুন্দর, তাই না? পনেরো শতকে ইনকাদের তৈরি ড্রিংকিং কাপ। কল্পনা কর, প্রায় পাঁচ শ বছর আগের! স্কুলে তোরা ইনকাদের কথা পড়েছিস?’
মাথা ঝাঁকাল ছেলেরা।
‘ওরা পেরুতে বাস করত। পোর্টার জাদুঘর ওদের কিছু মৃৎশিল্প আর সোনার ভাস্কর্য ডিসপ্লে করবে।’
বাক্সের কিনারা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে পিনাটের গভীরে হাত ভরে দিল হিরু চাচা।
‘আহা, এটা মনে হয় জাগুয়ারটা!’
খোঁত করে শব্দ করে অপেক্ষাকৃত বড়সড় একটি প্যাকেজ বের করল। কিশোরের বাহুর সমান লম্বা, কোমরের সমান মোটা। হিরু চাচা প্যাকেজটাকে ডেস্কের ওপর রাখলে ‘ধুপ’ করে শব্দ হলো।
‘এটা এত ভারী কেন, হিরু চাচা?’ মুসার প্রশ্ন।
‘সোনা ভারী ধাতু,’ ব্যাখ্যা করল হিরু চাচা। ‘ইনকারা শক্তিমত্তা আর ধূর্ততার জন্য জাগুয়ারদের পছন্দ করত। এটা খাঁটি সোনার তৈরি। সামনের দুই থাবায় দুর্দান্ত এক পান্না রয়েছে এটার।
‘দেখতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘হ্যাঁ, তবে কালকের আগে নয়। ড. ক্রুক সকাল নয়টায় এখানে আসবেন, সোসাইটি অব ইনকান ট্রেজার্সে কাজ করেন তিনি। প্রতিটি টুকরো র৵াপিং খুলে খুলে তাঁকে দেখতে হবে।’
‘কেন?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘সবকিছু ঠিকঠাকমতো পৌঁছেছে কি না, শিওর হওয়ার জন্য। বুঝতেই পারছ এগুলো অমূল্য সম্পদ!’
বাক্সের ভেতর জাগুয়ারটাকে রেখে দিল হিরু চাচা।
‘ঠিকমতো ঘুমা!’ বলল।
এবার টুলবক্সে হাত ভরে একটি হ্যামার বের করল। মুসার হাতে দিল।
‘এসো, কাপটাকে আবারও মুড়ে, পেরেক মেরে বাক্সটা বন্ধ করে দিই। কাল খুলব।’
কাজটা হয়ে গেলে হিরু চাচা বলল, ‘এখন চলো এখানে তালা মেরে আমার অ্যাপার্টমেন্টে যাই। তোদের ব্যাকপ্যাক পিটারের কাছে রাখি, তারপর তোদের নিউইয়র্কের খানা খাওয়াব!’
‘পিটার কে, হিরু চাচা?’ মুসার প্রশ্ন।
‘আমার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের দারোয়ান,’ বলল হিরু চাচা। ‘ভাড়াটেদের জন্য গেট খোলে, ট্যাক্সির জন্য হুইসেল দেয়।’
‘আপনার বন্ধুর রেস্টুরেন্টে খাওয়াবেন না, হিরু চাচা?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, তবে আজকে নয়। তোরা চলে যাওয়ার আগের রাতের জন্য সেটা তোলা রইল। তোরা কী ধরনের খাবার পছন্দ করিস?’
‘পিৎজা আর আইসক্রিম,’ সবার হয়ে জবাব দিল মুসা।
হেসে উঠল কিশোর।
‘মুসা সবই খায়।’
‘আমি বলতে চাইছিলাম কোনটা খাবি—জাপানিজ, চায়নিজ, ইতালিয়ান, গ্রিক, ইন্ডিয়ান, নাকি মেক্সিকান খাবার!’ হিরু চাচা জিজ্ঞেস করল।
‘তোমার যা ইচ্ছে!’ বলল কিশোর। ‘আমরা সারপ্রাইজ ভালোবাসি!’
হিরু চাচা দেয়ালের সুইচগুলো বন্ধ করে দিল। আলো, বাজনা, পাখা—সব বন্ধ হয়ে গেল। অফিস থেকে চাচাকে অনুসরণ করে বেরোল তিন বন্ধু।
‘তাহলে তোদের সারপ্রাইজই দেব!’ বলে দরজাটা লাগিয়ে দিল হিরু চাচা।
No comments:
Jhu Jhu
Welcome to my blog. I don't know how much my blog will help you. Can not help as you like? Let me know your choice in the comments to get your choice. I will try to give your favorite poems and books. Thank you for coming to my blog, come back .