![]() |
আর. এস. দেওয়ান |
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান, যিনি আর. এস. দেওয়ান নামেই বেশি পরিচিত, ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আন্দোলনের এক নীরব সৈনিক। কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি লাভ করার পর তিনি লোভনীয় পেশার জীবন ত্যাগ করে জুম্ম জাতির অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর এই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও দৃঢ় সংকল্পের জীবন অনেকের কাছেই অনুসরণীয়।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
ড. দেওয়ান ১৯৩২ সালের ১৭ জানুয়ারি বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবংপড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাত ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ ছিল এবং তিনি ১৯৬৭ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি বিশ্বখ্যাত স্যালফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮০ সালে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের (আর. এস. দেওয়ান) রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়েছিল তাঁর ভাগ্নে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (PCJSS) প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অনুরোধে।
১৯৭৪ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যখন লন্ডন সফর করেন, তখন তিনি তাঁর মামা ড. দেওয়ানকে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারণার গুরুদায়িত্ব গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। লারমার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ড. দেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার নিশ্চিত জীবন ত্যাগ করেন এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে উৎসর্গ করেন।
তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার, মানবাধিকার সংস্থা এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ডসভার সদস্যদের কাছে জুম্ম জনগণের ওপর নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদর দপ্তরে WGIP (Working Group on Indigenous Populations)-এর অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ভাষণ দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে সোচ্চার হয়।
ব্যক্তিগত জীবন ও শেষ দিনগুলি
ড. দেওয়ান একজন সৎ, নিষ্ঠাবান এবং অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি কখনো নিজের আরাম-আয়েশের দিকে মনোযোগ দেননি। নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে তিনি আজীবন স্বজাতির জন্য কাজ করে গেছেন। এমনকি তিনি বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তিনি বলেন, “জনসংহতি সমিতির সদস্যরা যদি তীব্র শীতে রাত-বিরাতে জঙ্গলে থাকতে পারে, তাহলে আমি কেন বিদ্যুৎ ও হিটার ছাড়া ঘরে থাকতে পারব না?”
জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি কিছুটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন। ২০২১ সালের ২৯ মার্চ ম্যানচেস্টারে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর সঠিক সময়ে জানা যায়নি, এবং সেখানকার পুলিশই তাঁর লাশ উদ্ধার করে সৎকার করে। তাঁর এমন নিঃসঙ্গ ও করুণ মৃত্যু অনেককে ব্যথিত করে।
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান জুম্ম জাতির জন্য যে আত্মত্যাগ ও অবদান রেখে গেছেন, তা চিরস্মরণীয়। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেম কেবল মুখের কথা নয়, বরং তা সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়।
তথ্যসূত্রঃ-
১। মঙ্গল কুমার চাকমা,`ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাক্ষাৎকার`।
২। ধীমান খীসা, `ড. আর. এস. দেওয়ানের শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কিত লেখা`।
৩। অনলাইন পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম,`বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিচারণামূলক লেখা ও পোস্ট`।
৪। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, `অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রতিবেদন`।
৫। গণমাধ্যম, `তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন`।
No comments:
Jhu Jhu
Welcome to my blog. I don't know how much my blog will help you. Can not help as you like? Let me know your choice in the comments to get your choice. I will try to give your favorite poems and books. Thank you for coming to my blog, come back .