Search This Blog

পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৮টি’র গনহত্যার বিবরণ - এডিসন চাকমা

 

পাহাড়ের গনহত্যা !
১৯৭১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনী, রক্ষিবাহিনী, বিজিবি, আনসার, ভিডিপি এবং সেটেলারদের আক্রমনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে মোট ২৮ টি গনহ*ত্যা সংগঠিত হয়।
১*
পানছড়ি-দিঘীনালা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(৫ ডিসেম্বর ১৯৭১):
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের দুইটি গ্রুপ ভারতের ত্রিপুরা থেকে এক গ্রুপ পানছড়ি এবং আরেক গ্রুপ দিঘীনালা হয়ে প্রবেশ করে | চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ার ক্ষোভের কারনে সেই মুক্তিযোদ্ধারা একই দিনে পানছড়িতে ১৮ জন এবং দিঘীনালায় ১৬ জন নিরস্ত্র সাধারন পাহাড়িকে হত্যা করে | এই গনহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্টাতা সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরি।
২*
কুকিছড়া গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১):
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধিনতা লাভের ঠিক আগ মূহুর্তে মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার কুকিছড়া নামক স্থানে ২২ জন নিরস্ত্র সাধারন পাহাড়িকে হত্যা করে এবং ২০০ এর অধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় | এই গনহত্যারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্টাতা সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরি।
৩*
দিঘীনালা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৯৭২):
বাংলাদেশ স্বাধিনতা লাভের পরে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানি দোসর "রাজাকার" এবং "আলবদর" -দের একটি প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ প্রদান করেন | তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং রক্ষিবাহিনী দিঘীনালার মেরুং-হাজাচরা-বোয়ালখালীতে কয়েকশ পাহাড়িকে হত্যা করে, শত শত বাড়িতে লুটপাট এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয় | অনেক নারী ধর্ষিত হন, এবং কয়েক হাজার পাহাড়ি অযথাই গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন |
৪*
থানচি গনহত্যা, বান্দরবান(নভেম্বর ১৯৭৬-জানুয়ারী ১৯৭৭):
বাংলাদেশী সেনাবাহিনী ১৯৭৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বান্দরবান জেলার থানচিতে সাংগু নদীর উপরের অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে শতাধিক পাহাড়িকে হত্যা করে, বহু নারী ধর্ষিত হয় এবং ১৫ হাজারের অধিক পাহাড়ি মায়ানমারে দেশান্তরি হতে বাধ্য হয় |
৫*
মাটিরাঙ্গা-গুইমারা-মানিকছড়ি-লক্ষিছড়ি গন*হত্যা, খাগড়াছড়ি(১৯৭৭):
১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে সরকারি বাহিনী বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি এলাকার পাহাড়িদের উপর গন*হত্যা চালায় | এতে ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, ২৩ জন নারীকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় | পরবর্তীতে ৫৪ জনের একটি গনকবর আবিষ্কৃত হয় | গ্রামবাসীদের সম্পদ লুট করা হয় এবং শত শত ঘরবাড়ি এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয় | ৫,০০০ পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থি হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় |
৬*
দুমদুম্যে-মৈডং-পানছড়ি, রাঙ্গামাটি (ডিসেম্বর ১৯৭৮-জানুয়ারী ১৯৭৯):
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যে মৌজা (মৌজা#১৫০), মৈডং মৌজা (মৌজা#১৩৮) এবং পানছড়ি মৌজার (মৌজা#১৩৭) ১৭৫ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত একটি বৃহৎ অঞ্চলে আক্রমণ চালায় | এতে ৫০টি গ্রামের পাহাড়িরা ভুক্তভোগী হয় | শতাধিক পাহাড়িকে হত্যা করা হয় এবং বহু নারী ধর্ষিত হয় | প্রায় সমস্ত ঘরবাড়ি এবং বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয় | এই আক্রমন পরবর্তীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছিল অনাহারে |
৭*
মুবাছড়ি গ*নহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৫ অক্টোবর ১৯৭৯):
১৯৭৯ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মুবাছড়ি ইউনিয়নের ১৬ বর্গমাইলের মধ্যে সব গ্রাম পুড়িয়ে দেয়, কয়েক হাজার পুরুষ, নারী এবং শিশুকে হত্যা করে | বহু নারীকে ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় | এই ঘটনার পরে পুরো এলাকাটি শান্তিবাহিনীরা অক্ষত রেখে "গনহত্যা জাদুঘর" বানিয়ে রেখেছিল যা সাংবাদিক সালিম সামাস তার ক্যামেরাতে প্রথম তুলে নিয়ে আসেন | সেই ছবি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী সেই গনহত্যা জাদুঘর নিশ্চিহ্ন করে দেয় |
৮*
কাউখালি গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(১৯৮০):
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে সেটেলার বাঙালি পূর্নবাসন শুরুর পরে সেনা+সেটেলার মিলিত প্রথম গনহ*ত্যা এটি | ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির উপর চালানো গনহ*ত্যার ঠিক মাত্র ৯ বছর পরে সেই বাঙালিরাই পাহাড়িদের উপর এক নারকীয় গন*হত্যা চালায় ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ | রাঙ্গামাটির খাউখালি উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নের সব গ্রামের পাহাড়িদেরকে সেদিন বৌদ্ধ মন্দির সংষ্কার বিষয়ক একটি মিটিংএ ডাকে সেনাবাহিনী | মিটিং-এ উপস্থিত নিরস্ত্র পাহাড়িদেরকে সেনাবাহিনী অতর্কিত ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করে | এতে ঘটনাস্থলেই কয়েকশত পাহাড়ি নিহত হয় | যারা সেনাবাহিনীর গুলিতে শুধুমাত্র আহত হয়েছিল তাদেরকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় পূনর্বাসিত সেটেলারদের উপর | সেটেলার বাঙালিরা বাকি আহত পাহাড়িদেরকে দা দিয়ে কুপিয়ে, পিঠিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে | শত শত পাহাড়িদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় | এই গনহত্যায় প্রায় ৪০০ জন পাহাড়ি নিহত হয় | সেই জায়গাগুলি আজও সেটেলার বাঙালিদের দখলে | তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমান সরকারের অধীনে একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় | ২২ ও ২৩ এপ্রিল ১৯৮০ শাজাহান সিরাজ এমপি, রাশেদ খান মেনন এমপি ও উপেন্দ্র লাল চাকমা এমপি, এই তিন সংসদ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কাউখালী গণহত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান এবং পরিদর্শন শেষে তারা ২৫ এপ্রিল ১৯৮০ ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে উক্ত ঘটনার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পূনর্বাসিত সেটেলারদের দায়ী করে বিবৃতি প্রদান করেন |
৯*
হরিনা গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(১৯৮০):
১৯৮০ সালের ১০, ১৯, ২১ এবং ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলস রাঙ্গামাটির জেলার দুর্গম হরিণা উপত্যকার শুকনাচরী, মহালছড়ি, নুওআদাম, চিবেরেগা, তোইমিডং, টাগলকছড়া, এবং রাঙ্গাপানিছড়ার ৭ টি গ্রামের উপর চড়াও হয়ে গ্রামবাসীর উপর গনহত্যা চালায় এবং সবগুলি গ্রাম পুড়িয়ে দেয় | সেই জায়গাগুলি আজ সেটেলার বাঙালিদের দখলে |
১০*
রামগড় গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(২৬ জুন ১৯৮১):
রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে বসতি স্থাপন করা সেটেলার বাঙালিরা ১৯৮১ সালের ২৬ জুন বানরাইপাড়া, বেলতালি ও বেলছাড়ি এলাকার পাহাড়িদের উপর আক্রমণ করে শতাধিক পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে এবং তাদের গ্রাম ও কৃষি জমি দখল করে | ৫,০০০ জন পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী হতে বাধ্য হয় |
১১*
মাটিরাঙ্গা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮১):
১৯৮১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার ফেনী উপত্যকার তেলাফাং, আশালং, গুরাঙ্গাপাড়া, তবলছড়ি, বরনালা ইত্যাদিসহ ৩৫টি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালায় সেটেলার বাঙালিরা | গ্রামগুলো লুটপাট এবং পুড়িয়ে দেয়, এবং অসংখ্য পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে |
১২*
গোলকপতিমাছড়া-মাচ্ছ্যাছড়া-তারাবনছড়ি গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(জুন-অগাস্ট ১৯৮৩):
২৬ জুন, ১১, ২৬, ২৭ জুলাই এবং ৯, ১০, ১১ আগস্ট ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা মিলে গোলাকপটিমাছড়া, মাচ্ছ্যাছড়া, তারাবনিয়া, লোগাং, তারাবন্যা, মরমচ্যাছড়া, জেডামাছড়া ইত্যাদি গ্রামের পাহাড়িদের উপর গনহত্যা চালায় | শত শত বাড়ি লুটপাট ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শতাধিক পাহাড়িকে হত্যা করা হয় | নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু | পাহাড়িদেরকে এলাকাছাড়া করার পরে সেসব স্থানে সেটেলার বাঙালিরা বসতি স্থাপন করে |
১৩*
ভূষনছড়া গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(৩১ মে ১৯৮৪):
১৯৮৪ সালের ৩১ মে সকালে শান্তি বাহিনীর গেরিলারা রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার গোরস্তান, ভূষনছড়া এবং ছোটাহরিনা এলাকার সেটেলার বসতিতে হামলা চালায় এবং ঐ এলাকার তিনটি বিজিবি ক্যাম্পেও আক্রমন চালানো হয় | এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে পরবর্তীতে ৩১ মে এবং পরের দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৬তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০৫ তম ব্রিগেডের সদস্যরা, ১৭ তম ব্যাটালিয়নের বাংলাদেশ রাইফেলসের সদস্যরা, সেটেলার বাঙালিদেরকে সঙ্গে নিয়ে সুগুরি পাড়া, গোরস্তান, তারেঙ্গ্যা ঘাট, ভূষনছড়া ইত্যাদি পাহাড়ি গ্রামের মোট ৪০০ জনকে হত্যা করা হয় | অনেক নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার পরে গুলি করে হত্যা করা হয় | প্রায় ৭,০০০ পাহাড়ি ভারতের মিজোরামে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় |
একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাহাড়ি ঘটনার বর্ননা দিয়েছিলেন......
"৩১ মে সেনাবাহিনী এবং সেটেলাররা মিলে আমাদের গ্রামটি ধ্বংস করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং শত শত মানুষ হত্যা করে | আমি দুজন পাহাড়ি মহিলাকে ধর্ষণ হতে দেখেছি, ধর্ষনের পরে তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয় | শিশুদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় | বহু জনকে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল | আমাকেও মৃত মনে করে ফেলে গিয়েছিল কিন্তু দৈবক্রমে আমি বেঁচে যায় | সেই দিনের স্মৃতি এখনও আমার জন্য এক আতঙ্কের মত | সৈন্যরা পাহাড়ি নারীদেরকে ধর্ষনের পর গোপনাঙ্গে বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল আর চিৎকার করে বলছিল, "বাংলাদেশে আর কোনো চাকমা জন্মাবে না'"। রাষ্ট্রপতি এরশাদ ৫ জুন ১৯৮৪ সালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাটি পরিদর্শন করেন | শান্তিবাহিনী কর্তৃক সেটেলারদের উপর সংগঠিত হামলাটি বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় কিন্তু সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়িদের উপর হামলা নিয়ে কোন তথ্য প্রচারিত হয়নি |
১৪*
জুরাছড়ি গনহত্যা, রাঙ্গামাটি (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪):
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের ৩০৫তম ব্রিগেডের সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), সশস্ত্র পুলিশ (এপিবি), আনসার বাহিনী এবং সেটেলার বাঙালিরা মিলে রাঙামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার কয়েকটি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালায় | বহু পাহাড়ি নিহত হয় এবং কয়েকশ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় তারপর সেসব স্থানে সেটেলার বাঙালি বসতি স্থাপন করা হয় | এই আক্রমনে ৮ জন পাহাড়ি নারী ধর্ষিত হয় |
১৫*
পানছড়ি গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১ মে ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল শান্তি বাহিনী খাগড়াছড়ি জেলার আসালং, ছোট আসালং এবং তাইন্দং এর বিডিআর সীমান্ত চৌকিগুলোতে এবং পরে নতুন বসতি স্থাপন করা সেটেলারদের উপর হামলা চালায় | এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ১ মে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সেটেলার বাঙালিরা মিলে পানছড়ি-খাগড়াছড়ি এলাকার গোলকপতিমাছড়া, কালানাল, ছোট কর্মপাড়া, শান্তিপুর, মির্জিবিল, ক্ষেদারাছড়া, পূজগাং, লোগাং, হাতিমুর্তিপাড়া, সর্বেশ্বরপাড়া, নাপিতপাড়া, দেওয়ান বাজার ইত্যাদি পাহাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যা করে | এই ঘটনায় শতাধিক পাহাড়ি নিহত হয় এবং হাজারের অধিক ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় |
১৬*
মাটিরাঙ্গা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(২ মে ১৯৮৬):
উপরোক্ত ঘটনার পরে ক্ষতিগ্রস্থ সেসব গ্রামের পাহাড়িরা জীবন ভয়ে ২ মে ১৯৮৬ তারিখে ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের উপর কোন সতর্কতা না দিয়েই অতর্কিত এলোপাতারি গুলি চালাতে থাকে | এতে প্রায় ৭০ জনের অধিক পাহাড়ি ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যবরন করেন |
১৭*
মাটিরাঙ্গা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৮ মে ১৯৮৬):
শান্তিবাহিনী কর্তৃক ২৯ এপ্রিলের হামলার পরে বিডিআর এবং সেটেলাররা মিলিতভাবে পাহাড়িদের বিভিন্ন গ্রামে হামলা, লুটপাত ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে | ত্রিপুরাদের একটি দল যাদের বাড়িগুলি ৮ মে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা ভারতে শরনার্থী হওয়ার আশায় সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল; তাদেরকে বিডিআর এর ৩১ তম ব্যাটেলিয়ন এর জওয়ানরা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি আটক করে কুমিল্লাটিলা এবং তৈডং এর কাছাকাছি দুই পাশে পাহাড় আর মাঝখানে রাস্তা আছে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে এলোপাতারি গুলি করে প্রায় সবাইকে হত্যা করে | এতে প্রায় ২০০ জন ত্রিপুরা নিহত হয় | এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক প্রত্যক্ষদর্শী ত্রিপুরা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমরা বিডিআরদের অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলাম আমাদের কিছু না করার জন্য | আমরা তাদেরকে বলেছি আমরা চাকমা নই, আমরা ত্রিপুরা | শান্তিবাহিনীর সাথে ত্রিপুরাদের কোন সম্পর্ক নেয় | তারপরেও তারা আমাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল এবং ভারতে পালিয়ে আসার সময় হত্যা করেছিল |"
১৮*
দিঘীনালা গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৩-১৫ জুন ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ১৩ থেকে ১৫ জুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সেটেলাররা মিলে দিঘীনালা উপজেলার পাবলাখালি, কবাখালি, বড় মেরুং এবং ভৈরফা এলাকায় পাহাড়িদের মোট ২৯টি গ্রামে হামলা চালিয়ে হত্যা, লুটপাত, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলা এবং জোর পূর্বক ধর্মান্তরিতকরন করে | এই হামলায় কয়েকশ পাহাড়ি নিহত হয় এবং ৪৩ হাজার পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী হতে বাধ্য হয় | পার্বত্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিচালিত একটি অনাথ আশ্রম যেখানে ৩০০ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করত | সেনাবাহিনী আর সেটেলাররা সেখানেও হামলা চালায় | ৩০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মাত্র ১০৬ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় | বাকিদের আর কখনো খুজে পাওয়া যায়নি | ২০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় | পাহাড়িদের সেই জায়গাগুলিতে আজ সেনা ক্যাম্প এবং সেটেলার বাঙালি বসতি স্থাপন করা হয়েছে |
১৯*
মানিকছড়ি গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১-৫ জুলাই ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ১ থেকে ৫ জুলাই এর মধ্যে মানিকছড়ির হাটিমারা ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা মানিকছড়ির মারমা গ্রামগুলোর ওপর যৌথ আক্রমণ চালায় | এই আক্রমণে ১২ জন মারমাকে হত্যা করা হয় এবং ৭১টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় |
২০*
লংগদু গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(১২ জুলাই ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ১২ জুলাই সেটেলার বাঙালিরা লংগদুর রাঙেই পাড়া ও গুইছড়ি মুখ এলাকার ৫ জন চাকমাকে হত্যা করে | নিহতরা লংগদু থানার বড়াদাম থেকে আত্মীয়দের কাছ থেকে ধান ধার করে বাড়ি ফিরছিলেন | পথে বৈরাগী বাজার ও গুলশাখালীর মধ্যবর্তী স্থানে সেটলার বাঙালিদের একটি দল তাদের ঘেরাও করে ধানগুলি লুটে নেওয়ার পর হত্যা করে |
২১*
পানছড়ি গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(২১ জুলাই ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই পানছড়ি বাজার থেকে ফেরার পথে জীবনেশ্বপাড়ার ৬ জন চাকমাকে সেটেলার বাঙালিরা প্রথমে লুটপাত এবং হত্যা করে | উক্ত ৬ জনের মধ্যে নিহত তরুন চাকমার যুবতী মেয়েকে ধর্ষন করার পরে এক সেটেলার জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরীত বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে যায় | উক্ত সেটেলারটির বাড়িতে আগে থেকেই এক বউ বিধ্যমান ছিল | সেটেলারটির বউ, চাকমা মেয়েটিকে পালাতে সাহায্য করে |
২২*
মেরুং গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১৯ ডিসেম্বর ১৯৮৬):
১৯৮৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর দিঘীনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের চংড়াছড়িতে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প এর ক্যাপ্টেন শহীদ এর নেতৃত্বে রঞ্জন মনি কার্বারীপাড়া নামক চাকমাদের একটি গ্রামে রাত ২:০০ টার সময় সেনা এবং সেটেলার বাঙালিদের যৌথ আক্রমনে গ্রামের সবগুলি বাড়িতে লুটপাত ও পুড়িয়ে দেয় | হত্যা করা হয় ২০ জন গ্রামবাসীকে |
২৩*
লংগদু গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(৩০ জুলাই ১৯৮৮):
লংগদুর সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রজনী কান্ত চাকমা এবং আরও ৮ জন চাকমা মিলে একটি নৌকায় করে মাইনী মুখ বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন | নৌকার চালক মোহাম্মদ খলিল তাদেরকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মাইনী নদীর পশ্চিম তীরে সেটেলার বসতির "বট তলা" নামক স্থানে নিয়ে যায় | সেখানে আগে থেকে ঐৎ পেতে থাকা সেটেলাররা, তীরে পৌঁছানোর সাথে সাথেই যাত্রীদের উপর হামলা করে লুটপাত ও হত্যাযজ্ঞ চালায় | এতে নৌকার সব চাকমা যাত্রী(৯ জন) নিহত হয় |
২৪*
বাঘাইছড়ি গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(৩-১০ অগাস্ট, ১৯৮৮):
১৯৮৮ সালের ১ আগস্ট শান্তি বাহিনীরা সেনাবাহিনীর একটি দলকে আক্রমন করে ৭ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে | এই আক্রমনে প্রতিশোধ হিসেবে ৩ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনী আর সেটেলার বাঙালি সদস্যরা দুরছড়ি, খেদারমারা, বঙ্গলতুলি, সরওয়াতুলি, বাঘাইছড়ি ইত্যাদি গ্রামের চাকমা গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও এলোপাতারি গুলিতে হত্যা করে | গ্রামবাসীরা প্রানভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায় | উক্ত ঘটনার পরে ২৫ জন নারীকে কখনো আর খুজে পাওয়া যায়নি | নিহতদেরকে সেনাবাহিনীরা গনকবর দিয়েছিল |
২৫*
লংগদু গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(৪ মে ১৯৮৯):
১৯৮৯ সালের ৪ মে বিকেল ৪-৫ টার দিকে কিছু অস্ত্রধারী লংগদু উপজেলার সেটেলারদের নিয়ে গঠিত "ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি" নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদকে গুলি করে হত্যা করে | সেটেলার বাঙালিরা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ খুনের জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করে এবং পাহাড়িদের বিরুদ্ধে জঙ্গী মিছিল বের করে পাহাড়িদের ৬ টি গ্রামে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও লুঠপাত চালায় | এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই হত্যাযজ্ঞে ৪০ জন পাহাড়ি নিহত হয় | ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অনিল বিকাশ চাকমার ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনিসহ পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় | এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ স্বরূপ ‘৮৯ সালের ৯ই মে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, সাবেক সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও ন্যায়ানুগ বিচার দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করেন |
এই ঘটনার প্রতিবাদে ২১ মে ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয় | ২০ মে ১৯৮৯ সালের সন্ধাবেলা প্রশান্ত ত্রিপুরা (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান), বিধান চাকমা, শুভাশিস চাকমা, ধীরাজ চাকমা, মংথোয়াই মারমা ও প্রসিত বিকাশ খীসা (প্রাক্তন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সভাপতি এবং বর্তমান ইউপিডিএফ প্রধান) ছয় জনকে আহব্বায়ক করে গঠন করা হয় "পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ" |
২৬*
মাল্ল্যে গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(২ ফেব্রুয়ারী ১৯৯২):
১৯৯২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মারিশ্যা থেকে পাহাড়ি-বাঙালি বোঝাই রাঙ্গামাটিগামী লঞ্চটি দূরছড়ি বাজারের পরে মাল্ল্যে নামক স্থানে পৌছালে লঞ্চটিতে রাখা দুটি তেলের ড্রাম বিস্ফোরিত হয় | বিস্ফোরণে একজন সেটেলার বাঙালি যাত্রী নিহত এবং চালক গুরুতরভাবে আহত হন আর লঞ্চটি ডুবে যায় | অভিযোগ করা হয়, পাহাড়িরা বোমা বিষ্পোরন ঘটিয়েছে | অথচ লঞ্চটিতে থাকা পাহাড়ি যাত্রীরাও বিষ্পোরনের পরে প্রান বাঁচাতে সাতার কেটে পাড়ে পৌছানোর চেষ্টা করলে মাল্যের সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়িদেরকে পিঠিয়ে ও পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে | সেটেলারদের হামলায় ৩০ জন পাহাড়ি নিহত হয় | এর মধ্যে ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়, বাকিগুলো পানিতে হারিয়ে যায় |
২৭*
লোগাং গনহত্যা, খাগড়াছড়ি(১০ এপ্রিল ১৯৯২):
১৯৯২ সালের ৯ এপ্রিল একটি চাকমা মেয়ে গরু চড়াতে গিয়েছিল | মেয়েটিকে একা পেয়ে তিনজন সেটেলার বাঙালি ধর্ষনের চেষ্টা চালায় | মেয়েটির চিৎকার শুনে দুইজন চাকমা ছেলে প্রতিরোধ করে দাড়ায় এবং একজন সেটেলারকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে | বাকি দুজন সেটেলার আর্মি ক্যাম্পে দিয়ে অভিযোগ জানায় যে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা বাঙালিদের হত্যা করছে | এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ১০ এপ্রিল সেনাবাহিনী আর সেটেলাররা মিলিতভাবে লোগাঙ এলাকার ঘুমন্ত পাহাড়িদের উপর হামলা চালিয়ে লুটপাত, হত্যা, ধর্ষন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে | এতে এক রাতে ২০০ জন পাহাড়ি নিহত হয় এবং কয়েক হাজার পাহাড়ি ভারতে শরনার্থী হতে বাধ্য হয় |
২৮*
নানিয়াচর গনহত্যা, রাঙ্গামাটি(১৭ নভেম্বর ১৯৯৩):
১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ আয়োজিত একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পার্বত্য গন পরিষদ সভাপতি ও বুড়িঘাট ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ এবং মো: আইয়ুব হোসেন এর নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালিরা হামলা চালায় | প্রথমে সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়িদের উপর হামলা করলে, পাহাড়িরাও লাকড়ি ও লাঠিসোটা নিয়ে প্রতিরোধ করে দাঁড়ালে সেটেলাররা পিছু হটতে থাকে | এই সময় সেটেলারদের সাহায্য সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে এবং পাহাড়িদের উপর এলোপাতারি গুলি চালাতে থাকে | এতে ৬৬ জন পাহাড়ি নিহত এবং ৫০০ জনের অধিক আহত হয় |
তথ্যসূত্র:
১| Life is not ours:
the Chittagong Hill Tracts Commission, April 1994
২| Unlawful Killings and Torture in the CHT:
Amnesty International,1986
৩| Jana Samhati Samiti Report
৪| The Charge of Genocide:
Organizing Committee Chittagong Hill Tracts Campaign, 1986
৫| পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন-মহিউদ্দিন আহমেদ
৬| অতীতের কিছু স্মৃতি ও শান্তিবাহিনী-প্রীতি কুমার চাকমা



No comments:

Jhu Jhu

Welcome to my blog. I don't know how much my blog will help you. Can not help as you like? Let me know your choice in the comments to get your choice. I will try to give your favorite poems and books. Thank you for coming to my blog, come back .

Theme images by luoman. Powered by Blogger.