Search This Blog

আহসান হাবীবের কিশোর উপন্যাস 'সোনার সিন্দুক' (প্রথম পর্ব)

আজ অঙ্ক ক্লাস হবে না। স্কুলে গিয়ে এই খবর পেয়ে বেশ আনন্দ হলো ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রীদের।

আহসান হাবীবের কিশোর উপন্যাস 'সোনার সিন্দুক' (প্রথম পর্ব)

কারণ, বিনয় স্যার আজ স্কুলে আসেননি। শুধু আজকেই না, স্যার নাকি গত দুই দিন স্কুলে আসছেন না।

‘স্যার নিখোঁজ!’ নবর কানের কাছে ফিসফিস করল অপু।

‘তোকে কে বলেছে?’

‘সবাই জানে।’

‘মানে?’

‘মানে স্যারকে কেউ কিডন্যাপ করেছে!’

‘ধুর ধুর, স্যার বাড়ি গেছে। স্যারের বাড়ি সন্দ্বীপ, অনেক দূরে এক দ্বীপে; সেখানেই গেছে। স্যারের অনেক ছুটি পাওনা ছিল তাই ছুটি কাটাতে ...’

‘আরে না, ও ঠিকই বলেছে। স্যারকে সত্যিই কেউ কিডন্যাপ করেছে।’ আরেকজন নাক গলায়।

তবে স্কুলজুড়েই একটা ফিসফাস চলছে...স্যার নিখোঁজ, স্যারকে গুম করা হয়েছে। তবে স্যার তো স্কুল ফাঁকি দেওয়ার মানুষ না। কখনো ছুটিও নেননি। একবার প্রবল বৃষ্টিতে স্কুল ডুবে গেল। সব ক্লাসে হাঁটুপানি। সেই যে আটাশির বন্যায়...কিন্তু স্যার নাকি একটা ভেলায় চড়ে স্কুলে হাজির! তাহলে? তারপরও অনেকেরই ধারণা স্যারকে নাকি কেউ কিডন্যাপ করেছে। নব অবশ্য ইংরেজি স্যারের কাছে বিষয়টা জানতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। স্যার হুংকার দিয়ে বলেছেন—

‘গো টু ক্লাস...ডোন্ট ইন্টারফেয়ার...’ আরও কী সব ইংরেজিতে হাবিজাবি বলেছেন, বুঝতে না পেরে কেটে পড়েছে নব।

তার পরেই, মানে পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে ওদের প্ল্যানটা হলো।

ওদের খেলাধুলার গ্রুপে বুবলী বেশ মারদাঙ্গা টাইপের মেয়ে। কুংফু-কারাতে শেখে প্রতি বৃহস্পতিবারে। আজও সেই অদ্ভুত সাদা ড্রেসটা পরে আছে, তার মানে মোকাম ভাইয়ের কুংফু- কারাতে ট্রেনিং সেন্টার থেকেই আজ এসেছে ও। নব উদাস ভঙ্গিতে দক্ষিণের পাহাড়টার দিকে আবার তাকিয়ে বলল, ‘বেশ, ঠিক সকাল সাতটায় চলে আসিস বাতেন ভাইয়ের দোকানে। ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করব আমরা। আমরা মোট চারজন যাচ্ছি। বাতেন ভাই যখন জেনেই গেছে, তখন আর সমস্যা কী...রাজীবকে টাইমটা বলে দিস তোরা।’

পার্কের ভেতরে বড় জারুলগাছটার নিচে নব বসে বসে ঘাস খাচ্ছিল। মানে লম্বা ঘাসগুলো একটা একটা করে টেনে টেনে ছিঁড়ে চিবাচ্ছিল, আর একটু পর থুতুু করে ফেলে দিচ্ছিল। এটা ওর একটা অভ্যাস, মাটিতে বসলেই ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। তার ধারণা ঘাসে নাকি দারুণ সব ভিটামিন আছে, চোখের পাওয়ার বেড়ে যায়! ‘কোনো গরুকে চশমা পরতে দেখেছিস কখনো?’—এ রকমটাও বলে মাঝেমধ্যে। ঠিক তখনই রাজীব এল।

‘কিরে, খেলবি না?’

‘খেলা হবে না। ফুটবলের লিক সারাতে নিয়ে গেছে রন্টুরা। আজ মনে হয় আর সারানো হবে না।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আর কী, তোর মতো বসে বসে ঘাস চিবাই।’ বলে ধুপ করে নবর পাশে বসে পড়ে রাজীব। ‘আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?’

‘কী কাজ?’

‘চল, কাল আমরা দক্ষিণের পাহাড়ে উঠি।’

‘ওটা পাহাড় না, টিলা।’

‘ওই টিলার পেছনেই বড় বড় পাহাড় আছে।’

‘পাহাড়ে উঠে লাভ কী?’

‘ওখানে অনেক পেয়ারাগাছ আছে। ওই পেয়ারা যে একবার খেয়েছে, সে জীবনে ভুলতে পারবে না। ভেতরটা লাল আর সেই রকম মিষ্টি। সাইজে অবশ্য একটু ছোট।’

‘তুই খেয়েছিস?’

‘একবার খেয়েছিলাম, সে-ও অনেক আগে।’

‘গাছটা খুঁজে পাবি কোথায়?’

‘গাছ না, পেয়ারাবাগান ওটা।’

‘সেই পেয়ারাবাগান খুঁজে পাবি?’

‘সেটা পাওয়া যাবে।’ বলে দুজনেই একসঙ্গে দক্ষিণ দিকে তাকায়। ওদের ছোট্ট শহরটার ঠিক দক্ষিণ দিকে হবিগঞ্জ আর মৌলভীবাজার এলাকায় যে টানা আটটি পাহাড়ের শৃঙ্গ ধারাবাহিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার শুরু খুব সম্ভব ওই দিকেই। এখান থেকে আধা ঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছানো যায় ওই ছোট্ট পাহাড়টায়, মানে টিলাটায়, তারপরই বড় বড় পাহাড়। ওই ছোট্ট টিলাটাই কি ওই আটটি মূল শৃঙ্গের সঙ্গে যুক্ত? কে জানে।

‘কী, যাবি?’

‘যাব। যদি পেয়ারা মিষ্টি না হয় তাহলে তোর কিন্তু খবর আছে।’ রাজীব বলল।

‘কাল ছুটি আছে। সকালে চলে যাব বিকেলের মধ্যেই চলে আসব।’

‘আসতেই হবে। আমার কোচিং আছে। ছয়টার মধ্যে ফিরে আসতে পারব তো?’

‘অবশ্যই পারব।’

‘তুই রাস্তাঘাট চিনিস তো?’

‘চিনি মানে? পুরা ম্যাপ আমার মাথার মধ্যে।’

‘আগে গিয়েছিস?’

‘না, যাইনি।’

‘তাহলে?’

‘আরে বাবা, যারা গেছে, তাদের কাছে গল্প শুনতে শুনতে সব মুখস্থ হয়ে গেছে আমার...ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না। বাসায় কী বলবি, সেটা ঠিক কর।’

‘সে না হয় একটা কিছু বলে বেরিয়ে পড়ব।’

নব বাসায় ফিরে দেখে, অপু আর বুবলী দাঁড়িয়ে আছে। ‘তোরা?’

‘তোরা নাকি দক্ষিণের পাহাড়ে যাচ্ছিস?’

‘কে বলেছে? রাজীব?’

‘না, বাতেন ভাই।’

‘দোকানের বাতেন ভাই?’

‘তো বাতেন ভাই আর কয়টা আছে?’ বুবলী বিরক্তি প্রকাশ করে।

নব সশব্দে ‘উফ’ বলে তার মাথাটা চেপে ধরে। ‘এই রাজীব গাধাটা নিশ্চয়ই বাতেন ভাইয়ের দোকানে গিয়ে গপ্পো মেরেছে। এখন সবাই জেনে যাচ্ছে।’

‘জানলে সমস্যা কী?’ বুবলী বলে।

‘সমস্যা নেই। আবার আছেও।’

‘কী সমস্যা?’

‘জানিস তো, বিনয় স্যার নিখোঁজ। বেশ কদিন ধরে স্কুলে আসছেন না।’

‘তো?’ বুবলী আর অপু দুজনেই মুখ গোল করে কৌতূহলী চোখে তাকায় নবর দিকে!


‘অনেকে বলছে স্যারকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আমার ধারণা...’ নব চুপ করে যায়

‘কী ধারণা?’

‘স্যারকে ওই পাহাড়ের কোথাও আটকে রেখেছে।’

‘কারা আটকে রেখেছে?’

‘সেটা জানি না, হবে স্যারের শত্রুরা, স্যারের নিশ্চয়ই শত্রু আছে।’

‘তোর এটা মনে হচ্ছে কেন?’ অপু ভ্রু কুঁচকায়।

‘কারণ, আমি দেখেছি, স্যারকে মাঝে মাঝে ওই পাহাড়ের দিকে যেতে...তাই ভাবছিলাম, আমাদের ভ্রমণটাকে একটু সিক্রেট রাখতে।’ সিক্রেট শব্দটার ওপর নব যেন একটু বেশি জোর দিল। ওরা মাথা ঝাঁকাল, মানে ওরা নবর সঙ্গে একমত। ‘তোরা তাহলে সত্যি যাবি?’ নব সিরিয়াস।

‘যাব।’ দুজন একসঙ্গে বলল।

‘আমরা এক ঢিলে দুই পাখি মারব।’

‘কী রকম?’ এবার অপু ভ্রু কুঁচকায়।

‘আরে, ওখানে পেয়ারাবাগানের পেয়ারা খাব আর পারলে স্যারকে উদ্ধার করব।’

‘এহ!’ গলায় অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল বুবলী।

‘তোকে যেতে দেবে?’ বুবলীর দিকে তাকিয়ে বলল নব।

‘দেবে না কেন? অবশ্যই দেবে। তবে আমি পাহাড়ের কথা বলব না।’

‘কী বলবি?’

‘সেটা আমি বুঝব।’

ওদের খেলাধুলার গ্রুপে বুবলী বেশ মারদাঙ্গা টাইপের মেয়ে। কুংফু-কারাতে শেখে প্রতি বৃহস্পতিবারে। আজও সেই অদ্ভুত সাদা ড্রেসটা পরে আছে, তার মানে মোকাম ভাইয়ের কুংফু- কারাতে ট্রেনিং সেন্টার থেকেই আজ এসেছে ও। নব উদাস ভঙ্গিতে দক্ষিণের পাহাড়টার দিকে আবার তাকিয়ে বলল, ‘বেশ, ঠিক সকাল সাতটায় চলে আসিস বাতেন ভাইয়ের দোকানে। ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করব আমরা। আমরা মোট চারজন যাচ্ছি। বাতেন ভাই যখন জেনেই গেছে, তখন আর সমস্যা কী...রাজীবকে টাইমটা বলে দিস তোরা।’

‘ঠিক আছে।‘ সায় দিয়ে ওরা বাসার দিকে হাঁটা দিল।

সকাল আটার দিকে বুবলী আর অপু এসে হাজির বাতেন ভাইয়ের দোকানে। কাস্টমার নেই বলে বাতেন ভাই দোকান ঝাড়পোছ করছিল; কিন্তু রাজীবের খবর নেই।

‘কিরে, তোরা বলে পাহাড়ে যাবি?’ কোক-ফান্টার বোতল ফ্রিজে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে বাতেন ভাই।

‘কে বলেছে? নাহ। মাথা নাড়ে নব। আড়চোখে বুবলীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। মুখ বাঁকায় বুবলী, যার অর্থ হতে পারে—যেতেও পারি, না-ও পারি।

বাতেন ভাইয়ের বয়স খুব বেশি হলে পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। অসম্ভব গপ্পোবাজ একজন মানুষ, গল্পের বেশির ভাগই চাপা। তার গপ্পের ঠেলায় কেউ দোকানে আসতে চায় না। সব বিষয়ে সে জানে। মানে তার অগাধ জ্ঞান। তাদের পাহাড়ে যাওয়ার প্ল্যান শুনে বলল—

‘আমি তো প্রায়ই যাই ওই পাহাড়ে। তোরা পাহাড়ে যাবি, আমাকে আগে বলা দরকার ছিল।’

‘আগে বললে কী হতো?’

‘আমি কিছু টিপস দিতাম।’

‘এখন দেন।’

‘যেমন ধর...গত মাঘ মাসে আমি যখন ৩ নম্বর পাহাড়টার মাথায় উঠলাম, আচমকা একটা অজগর প্যাঁচায়া ধরল আমারে।’

‘আপনি কী করলেন?’ নব বেশ বুঝতে পারছে বাতেন ভাইয়ের চাপা মারা শুরু হয়ে গেছে।

‘আমি প্রথম কিছু করলাম না। চুপচাপ প্যাঁচাইতে দিলাম অজগরটারে। প্যাঁচা ব্যাটা কত প্যাঁচাবি...’

‘ভয় পেলেন না?’ বুবলী জানতে চায়... সে-ও বুঝে গেছে বাতেন ভাইয়ের চাপা শুরু হয়ে গেছে!

‘কিসের ভয়? বাতেন শিকদার ভয় পাওয়ার পাবলিক না। অজগর সাপ পুরাই যখন প্যাঁচাইল আমারে, একবারে ধর পা থেইকা গলা পর্যন্ত, তখন চট কইরা একটা গাছের লগে অজগরের লেজটার সঙ্গে একটা গিট্টু মারলাম।’

‘বলেন কি? তারপর?’ অপুর চোখেমুখে কৃত্রিম বিস্ময়।

‘তারপর করলাম কী...আচমকা শুইয়া পইড়া ঢালু পাহাড়ের ওপর একটা গড়ান দিলাম। ব্যস এক গড়ানে সব প্যাঁচ খুইলা আমি ফ্রি...ওদিকে অজগরের লেজ তো গাছের ডালে বান্ধা! বুদ্ধিটা কেমন?’

‘এই যে বাতেন, গাছের ডালে অজগরের লেজ বান্ধা শেষ হইছে তোমার? আমারে জলদি এক কেজি চিনি দাও আগে...’

ওরা তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠল। এক কাস্টমার এসে পেছন থেকে বাতেনের গল্প শুনছিল বোধ হয়। বাতেন একটু অপ্রস্তুত। সে এখন চিনি মাপছে গম্ভীর মুখে।

এই ফাঁকে বুবলী কিছু কেনাকাটা করল। কিছু চিপসের প্যাকেট, একটা বড় কেক, একটা পানির বোতল আর ক্রিম বিস্কুট। অপুও কিছু কিনল। নব ভেতরে–ভেতরে বিরক্ত হলো। এত কিছু কেনার দরকার কী? আর বাতেন ভাইয়ের এখান থেকে কেনা মনে সে ঠিকই বুঝবে ওরা দূরে কোথাও যাচ্ছে। এসব মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাওয়া বিপদ। রাজীবের এখনো কোনো খবর নেই। যাকে নিয়ে প্ল্যান, সে-ই নেই।

নয়টা বেজে গেছে, আর দেরি করা যায় না। রাজীবকে ছাড়াই ওরা বেরিয়ে পড়ল। বাতেন ভাইকে বলে গেল ওরা চিড়িয়াখানায় যাচ্ছে। রাজীবের ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে, তাহলে ঠিকই বুঝবে ওরা কোথায় যাচ্ছে।

১০টার দিকে ওরা পাহাড়ের গোড়ায় এসে দাঁড়াল; দেখে তাদের পাড়ার বিশু পাগলা একটা ছোট দা হাতে বসে মাটি কোপাচ্ছে। বিশু পাগলা তাদের বেশ পরিচিত মুখ। বয়স ৩০-৪০ হবে। খালি গায়ে সারা শহরে ঘুরে বেড়ায়। হাতে থাকে কখনো লাঠি, কখনো গাছের ডাল। এখন দেখা যাচ্ছে, তার হাতে একটা জং ধরা ভোঁতা দা।

‘বিশু আঙ্কেল কী করেন?’

‘পাহাড় কাটি।’ তার বলার ধরনে ওরা তিনজনই হেসে ফেলল।

‘পাহাড় কেটে কী হবে?’ বুবলী জানতে চায়।

‘পাহাড়ের গোড়া কাইটা দিলে দেখবা কী সুন্দর পাহাড়টা আসমানে উইঠা যাইব।’

‘কেন, পাহাড় কি গ্যাস বেলুন নাকি?’ অপু চোখ টেপে।

‘এই তো ঠিক ধরছ...পাহাড়ের পেটে হিলিয়াম গ্যাস আছে...গোড়া কাইটা দিলে ঠিক গ্যাস বেলুনের মতো উপরে উইঠা যাইব।’ বলেই বিশু ফের কোপাতে থাকল মাটিতে।

ওরা বিশু পাগলাকে ঘাটাল না। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। দ্রুত পাহাড়ে উঠতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশু পাগলা পেছন থেকে চ্যাঁচাল, ‘ওই দেইখো ২ নম্বর পাহাড়টার ওপরে বেশিক্ষণ থাইকো না। ওইটার গোড়া কাটা কিন্তু শেষ। ওইটা কইলাম আসমানে উইঠা যাইব একটু পরে...’

‘আচ্ছা উঠব না।’ ওরা বলে।




No comments:

Jhu Jhu

Welcome to my blog. I don't know how much my blog will help you. Can not help as you like? Let me know your choice in the comments to get your choice. I will try to give your favorite poems and books. Thank you for coming to my blog, come back .

Theme images by luoman. Powered by Blogger.